মানুষের হাস্যরসের জগতে প্রাণীরাও আজ আর নিরাপদ নয়। সম্প্রতি সিলেট থেকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি কোলে নিয়ে আছেন একটি নিরীহ সান্ডা প্রাণীকে। সেই নিরীহ দৃশ্যই মুহূর্তেই রূপ নেয় ট্রলের তাণ্ডবে। প্রাণীটির ভিন্ন গঠন ও স্বভাবকে পুঁজি করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য বিকৃত মিম, যৌন রসিকতা এবং কুরুচিপূর্ণ ভিডিও।
তবে শুধু সান্ডাই নয়—মানুষের কৌতুক ও বিদ্রূপের শিকার হয়েছে আরও অনেক প্রাণী। প্রাণীদের নিয়ে এই বিকৃত রসিকতার সংস্কৃতি যেন এক নির্লজ্জ সামাজিক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে।
ল্যামা, লাতিন আমেরিকার এক প্রাণী, ‘স্টুপিড বাট কিউট’ মেম সংস্কৃতিতে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তার হাঁটার ধরন ও মুখভঙ্গিকে নিয়ে তৈরি হয় অবজ্ঞাপূর্ণ কনটেন্ট। থুতু ফেলার স্বভাব তাকে বানিয়েছে ‘রুড অ্যানিমেল’।
শ্লথ, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি প্রাণী, ধীর গতির জন্য পরিণত হয়েছে ‘লেইজি লাইফ গোলস’ বা ‘মানডে মুড’ নামক হাস্যরসের প্রতীক। অথচ এই ধীরতাই তার টিকে থাকার কৌশল।
গাধা—যাকে সাহিত্যে, রূপকথায় ও কথ্য ভাষায় মূর্খতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়—বাস্তবে সে অত্যন্ত পরিশ্রমী, সহিষ্ণু ও নিরীহ এক সঙ্গী।
উটকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। তার মুখভঙ্গিকে ব্যবহার করে বানানো হয় ‘গ্রাম্পি ওল্ড ম্যান’ মিম, অথচ এই প্রাণীই প্রতিকূল মরুভূমির প্রতীক হয়ে টিকে থাকে।
কুকুর ও বিড়াল, মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী, তাদের স্বাভাবিক আচরণকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তৈরি হয় ট্রেন্ডিং ভিডিও ও মিম—যেখানে মানবিক সম্পর্কের বন্ধনকে রূপান্তর করা হয় হাসির পাত্রে।
সান্ডা বা প্যাঙ্গোলিন একটি নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণী, যার শরীর ঢেকে থাকে কেরাটিন দিয়ে তৈরি শক্ত আঁশে। ভয় পেলে সে নিজেকে বলের মতো গুটিয়ে নেয়, যা তার আত্মরক্ষার প্রাকৃতিক উপায়। কিন্তু সেই নিরীহ আচরণই আজ হয়ে উঠেছে ট্রলের খোরাক।
২০২৫ সালের মে মাসে সিলেটের একটি ভিডিওতে দেখা যায় সান্ডাকে কোলে নিয়ে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। সেটিই মুহূর্তে রূপ নেয় যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ট্রল, বিকৃত ক্যাপশন আর কুরুচিপূর্ণ কনটেন্টের জোয়ারে। একটি নিরীহ প্রাণীকে পরিণত করা হয় বিকৃত কল্পনার চরিত্রে।
এই প্রবণতা আমাদের সংবেদনশীলতার সংকটের প্রতিচ্ছবি। যারা ইন্টারনেটকে ‘নির্বাধ বিনোদনের মাঠ’ মনে করে, তারা ভুলে যায় যে রসিকতা ও অবমাননার মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম পার্থক্য।
প্রশ্ন ওঠে—আমরা কি এতটাই মানসিকভাবে অবক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়েছি যে, একটি প্রাণীকেও এখন কৌতুকের নামে বিকৃত কনটেন্টে পরিণত করি? আমরা কি এখনো মানবিক সমাজে বাস করছি, নাকি এক নির্মম ও বেহায়া তামাশার যুগে প্রবেশ করেছি?
সান্ডা শুধু একটি প্রাণীর নাম নয়—সে আমাদের বিবেকের আয়নায় তুলে ধরেছে এক কদর্য চেহারা, যেখানে বিকৃত রসবোধ, যৌনতাব্যঞ্জনার অতিরঞ্জন ও সামাজিক অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট।
প্রাণীদের নিয়ে কৌতুক করা বন্ধ করা হয়তো সম্ভব নয়, তবে তার রুচি, মাত্রা ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় নেওয়া এখন সময়ের দাবি। কারণ, আমরা কাকে হাস্যকর বানাচ্ছি এবং কেন—এই প্রশ্নেই লুকিয়ে আছে আমাদের মানবিকতার পরিচয়।
সান্ডা থেকে গাধা—সব প্রাণীই আমাদের মতোই এই পৃথিবীর অধিবাসী। আজ যদি আমরা তাদের নিয়ে কৌতুকের নামে কুরুচিপূর্ণ সীমা ছাড়িয়ে যাই, তবে কাল আমরা নিজেরাই নিজেকে হাস্যকর করে তুলব।