মোস্তফা কামাল পাশা, যিনি কামাল আতাতুর্ক নামে পরিচিত, তুরস্কের ইতিহাসে এক অনবদ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর নেতৃত্বেই আধুনিক তুরস্কের জন্ম হয়। তুর্কি জাতির জনক হিসেবে পরিচিত এই মহান নেতা ১৮৮১ সালে বর্তমান গ্রিসের থেসালোনিকি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কাঠ ব্যবসায়ী বাবার সন্তান হয়েও তিনি সামরিক শিক্ষায় অগ্রসর হন এবং মাত্র ১২ বছর বয়সে সামরিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯০৫ সালে ইস্তাম্বুলের সামরিক একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে লিবিয়ায় ইতালির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, বলকান যুদ্ধ ও ১৯১৫ সালে দার্দানেলিস যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তির চাপিয়ে দেওয়া শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে ১৯১৯ সালে আনাতোলিয়ায় জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের ডাক দেন কামাল আতাতুর্ক। তাঁর নেতৃত্বে
গ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয় এবং সেভরেস চুক্তির পরিবর্তে ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে তুরস্ককে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। একই বছর কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেন, যা ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল।
কামাল আতাতুর্ক আধুনিক তুরস্কের রূপকার হিসেবে একাধিক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেন। তিনি নারীমুক্তির পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন, ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো বিলুপ্ত করেন, আরবিতে আজান নিষিদ্ধ করেন, এবং পশ্চিমা পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানাবিধ সংস্কার চালু করেন। তিনি আরবি বর্ণমালার পরিবর্তে লাতিন বর্ণমালা প্রবর্তন করেন এবং ইউরোপীয় আইনের আদলে নতুন আইন ব্যবস্থা চালু করেন। ১৯৩৫ সালে তাকে “আতাতুর্ক” উপাধিতে ভূষিত করা হয়, যার অর্থ “তুর্কিদের জনক”।
তুরস্কের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কামাল আতাতুর্ককে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ও কেমালিজম আজও তুরস্কের রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এরদোয়ান সরকারের শাসনামলে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিতর্ক উঠে আসে, বিশেষ করে ইসলামী ভাবাদর্শের প্রতি সরকারের সমর্থনকে ঘিরে। অনেকে মনে করেন, কামাল আতাতুর্কের সংস্কারগুলি ধর্মের ভূমিকা সীমিত করার কারণে কিছু সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর তুরস্কের রাজনৈতিক অঙ্গনে একধরনের ঐক্য ফিরে আসে এবং কামাল আতাতুর্ককে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতে থাকে। যদিও বর্তমান সরকার তাঁর কিছু নীতির বিরোধিতা করে, তবুও তুরস্কের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে তাঁর অবদান অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
আতাতুর্কের মৃত্যুর প্রায় ৮৫ বছর পরও তুরস্কের জনগণের মধ্যে তাঁর প্রভাব অটুট রয়েছে। তুরস্কের লেখক নেদিম গুরসেল বলেন, “তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের প্রতি বিরাট সমর্থন রয়েছে, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর সমালোচনাও করা উচিত।” এটি প্রমাণ করে যে আধুনিক তুরস্কের ভবিষ্যৎ এবং জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে কামাল আতাতুর্কের আদর্শ আজও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়।