২০২৪ সাল একটা মাইলফলক। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। তবে নারীর জীবনে তা কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়নি। অভিভাবকত্ব, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তিতে অসমতায় এখনো আগের অবস্থায় আছেন নারীরা।
আজ সোমবার ‘সর্বজনকথা’ আয়োজিত দিনব্যাপী এক সেমিনারে লিঙ্গীয় বৈষম্য নিয়ে বক্তারা এ কথা বলেন। ‘স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শিরোনামে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে।
সেমিনারে ‘লিঙ্গীয় বৈষম্যের নানান রূপ ও করণীয়’ পর্বে বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তাঁরা নারীকে দমন করে রাখার বিরুদ্ধে বেশি বেশি করে কথা বলা, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও নারীর জন্য সমঅধিকারের জায়গা তৈরির ওপর জোর দেন।
মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে তরুণীরা ছিলেন। আন্দোলন শেষে তাঁরা নেই। আন্দোলনের পর নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়া এক নারীর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, তিনি থাকবেন কীভাবে? যখন নেতৃত্বের প্রশ্ন এল তখন সে জায়গায় এল তাঁর পুরুষ সহপাঠী। তাঁরা এমনিতেই সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। নেতৃত্বের জন্য নেটওয়ার্ক, যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি চাইলেও তাতে ঢুকতে পারতেন না। রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই এখানে এমন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যতই হাহাকার করি না কেন, এটাই হওয়ার কথা ছিল। এই রাজনীতিতে নারী ও ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের জন্য কিছু তৈরি নেই। আমাদেরই তৈরি করে নিতে হয়। সব প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে পিতৃতান্ত্রিকতার সুবিধার কথা ভেবে।’
সামিনা লুৎফা বলেন, ২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান একটি মাইলফলক। গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। তবে ‘৩৬ জুলাইয়ের’ পরও নারীর জীবনে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যায়নি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় গত বছরের প্রথম ৯ মাসে ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নিপীড়নের শিকার নারীদের এক ভাগ বিচার চাইতে চায়। ফলে বোঝা যায়, নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশির ভাগ বিচার চাইতে যান না পারিবারিক বাধা ও সম্মানহানির ভয়ে। তিনি আরও বলেন, শ্রমবাজারেও এক দশক ধরে নারীর বাধাভাঙা অংশগ্রহণ রয়েছে। তা–ও পিতৃতান্ত্রিক বেড়াজাল ভেঙে নারী বের হতে পারেননি। এখনো বাল্যবিবাহের শিকার, যৌতুকের জন্য নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটছে। সম্পত্তি, অভিভাবকত্ব, বিবাহবিচ্ছেদে সমান অধিকার নেই। সামিনা লুৎফা বলেন, যে প্রবল প্রতাপ নিয়ে নারীরা আন্দোলনে এসেছিলেন, সেই নারীদের আন্দোলনের পর বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি পরির্তনের জন্য নারীর স্বরকে আরও উচ্চকিত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যেসব রাজনৈতিক দল নারী নেতৃত্বকে সামনে না আনবে, তাদের ভোট দেওয়া থেকে নারীরা বিরত থাকবেন।
জাতিগত বৈচিত্র্যকে স্বীকার করতে হবে
‘জাতিগত সংকটের সমাধান কোন পথে?’ পর্বে বক্তব্যে দেন দৃক–এর গবেষক রেং ইয়ং ম্রো এবং গানের দল ‘মাদল’–এর শিল্পী আস্তনী রেমা। তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অংশ নিয়েছিল। অথচ স্বাধীনতার পর সংবিধান থেকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে জাতিগত সংকটের সৃষ্টি করা হয়। জাতিগত বৈচিত্র্যকে স্বীকার করাই সংকটের সমাধান বলে মনে করেন তাঁরা।
গবেষক রেং ইয়ং ম্রো হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে এসেছিলেন সেমিনারে। ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনের সামনে হামলায় তিনি আহত হন। সেমিনারে তিনি বলেন, দেশে জাতিগত বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে জাতিগত সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ‘আদিবাসীদের’ বুনো, অসভ্য, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার যে গ্রাফিতি পাঠ্যপুস্তকে ছিল, সেই গ্রাফিতিও মুছে দেওয়া হলো। তিনি অভিযোগ করেন, গ্রাফিতি পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে হামলাকারীরা পুলিশের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল।
শিল্পী আস্তনী রেমা বলেন, সংবিধানে ‘আদিবাসীদের’ জায়গা হয়নি। ২৪–এ–ও জায়গা হলো না। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ একটি পক্ষের একবার দাবির মুখেই গ্রাফিতি বাদ দিয়ে দিয়েছে। দেখে মনে হয়, ওই পক্ষটি দাবি করবে সেই অপেক্ষাতেই ছিল কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, বৈচিত্র্য সুন্দর। এই সৌন্দর্যকে দেখার জন্য সুন্দর চোখ তৈরি হোক সবার মধ্যে।
অনুষ্ঠানে সভাপ্রধান ছিলেন সর্বজনকথার সম্পাদক আনু মুহাম্মদ। সেমিনার সঞ্চালনা করেন ‘সর্বজনকথা’র গবেষক মাহতাব উদ্দীন আহমেদ ও সংগীতশিল্পী বীথি ঘোষ।