বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত পথঘাট আর রিকশার শব্দ পেরিয়ে আজ ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Oklahoma) গবেষণাগারে তাহসিন তাবাসসুম। পেশায় একজন নগর পরিকল্পনাবিদ, চিন্তাভাবনায় একজন ন্যায়বিচারপন্থী চিন্তাশীল নাগরিক। বর্তমানে তিনি ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজিওনাল অ্যান্ড সিটি প্ল্যানিং বিভাগে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এবং গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মরত।
তাহসিনের গবেষণার কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি বিষয়: পরিবহন ন্যায়বিচার, গণপরিবহন ব্যবস্থা, এবং ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা। তবে কেবল ভাবনায় নয়, তিনি সেই ভাবনাকে পরিসংখ্যান, স্পেশাল ডেটা বিশ্লেষণ ও মেশিন লার্নিংয়ের মতো শক্তিশালী গবেষণা কৌশলের মাধ্যমে বাস্তব প্রেক্ষাপটে অনুবাদ করছেন। তার গবেষণা একদিকে যেমন প্রযুক্তিনির্ভর, অন্যদিকে মানবিক এবং নীতিনির্ধারণমূলক, যেখানে প্রতিটি পথচারীর নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার গুরুত্বপূর্ণ।
তার একাডেমিক জীবন শুরু হয় বাংলাদেশের বুয়েট-এ, যেখানে তিনি ২০২২ সালে আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে, তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের “Centre for Climate Change and Environmental Research” এ গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন, যেখানে তিনি পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ও নগর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন।
২০২৩ সালে ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তার সাফল্যের ঝুলিতে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক সম্মাননা। তিনি বর্তমানে বিভাগীয় গবেষণা সহকারী এবং ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষক সহকারী হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। ২০২৪ সালের, তিনি কানসাসে অবস্থিত শক্তি ও পরিকাঠামো প্রতিষ্ঠান Enertech-এ জিআইএস ইন্টার্ন হিসেবে যুক্ত ছিলেন, যেখানে বাস্তবভিত্তিক জিওস্পেশাল ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাহসিন তার মাস্টার্সের কমপ্রিহেনসিভ পরীক্ষায় ৯৪.৬৫% স্কোর করে পুরো ব্যাচের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান অর্জন করেন। একই মাসে তিনি Three Minute Thesis (3MT) প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনালিস্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, যা তার গবেষণাকে সাধারণ দর্শকের সামনে সহজ ভাষায় উপস্থাপনার সক্ষমতার প্রমাণ।
তাহসিন গবেষণা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃতি পেয়েছে। তার গবেষণাপত্র গ্রহণ করা হয়েছে ACSP 2024 এবং ASCE ICTD 2025 সম্মেলনে। ACSP থেকে তিনি অর্জন করেছেন “Ed McClure Award for Best Master’s Student Paper”, যা তার প্রজ্ঞা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার স্বীকৃতি।
তার গবেষণার গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি বিবেচনা করে তিনি পেয়েছেন Christopher C. Gibbs Endowed Enrichment Scholarship এবং Gilbert Ludeman Memorial Scholarship-এ মনোনয়ন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই ও দাতাদের সম্মানে আয়োজিত ডিনারেও তিনি সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি GIS Day 2023-এও বক্তৃতা দিয়েছেন, যেখানে তার উপস্থাপনা শিক্ষার্থী ও গবেষকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে।
তাহসিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্পষ্ট—নগর জীবনকে মানুষের জন্য নিরাপদ, ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করে গড়ে তোলা। তার গবেষণা কেবল গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নয়; এটি শহরের রাস্তায়, বাসস্ট্যান্ডে, পথচারীর চাহনিতে প্রতিফলিত হওয়ার মতো এক বাস্তবধর্মী প্রচেষ্টা।
তাহসিন তাবাসসুম, সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যারা উন্নয়নকে শুধু অবকাঠামোতে নয়, মানুষকেও অন্তর্ভুক্ত করে দেখতে চায়। তাঁর সাফল্য প্রমাণ করে—বাংলাদেশি তরুণরাও বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে দক্ষতা, নিষ্ঠা ও মানবিক বোধ দিয়ে প্রভাব ফেলতে সক্ষম।