ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম বিরাট কোহলি, আনুষ্ঠানিকভাবে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ক্রিকেট ইতিহাসে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আধিপত্য বিস্তারকারী এই ব্যাটসম্যানের বিদায়ে শেষ হলো এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে বিরাট কোহলি হয়ে ওঠেন ভারতীয় ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং বিশ্ব ক্রিকেটের এক অন্যতম আইকন।
বিরাট কোহলির ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হয় ২০০৮ সালের আগস্টে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সময় নেননি তিনি। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য হিসেবে তার অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এরপর থেকে ভারতীয় দলের প্রায় প্রতিটি সাফল্যে তার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে যায়।
কোহলির ব্যাটিং ছিল আগ্রাসী, কিন্তু তা কখনোই অস্থিরতা তৈরি করত না। বরং তার টেকনিক, মনোসংযোগ, এবং ফিটনেসের প্রতি অসাধারণ নিবেদন তাকে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের কাতারে নিয়ে যায়। তিনি শুধু বড় রানই করেননি, চাপে পড়ে রান তাড়া করায় ছিলেন অনন্য। তার নামে রয়েছে ৮০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক শতক, যার মধ্যে ৪৯টি ওয়ানডে এবং ২৯টি টেস্ট সেঞ্চুরি।
২০১৪ সালে ধোনির বিদায়ের পর ভারতের টেস্ট অধিনায়ক হন কোহলি। পরবর্তী সময়ে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি দলেরও নেতৃত্ব পান। তার নেতৃত্বে ভারত টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্বসেরা দল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ জয় ছিল ঐতিহাসিক। তিনি দলকে আক্রমণাত্মক মানসিকতা, পেশাদারিত্ব এবং শারীরিক সক্ষমতায় অনন্য এক অবস্থানে নিয়ে গেছেন।
তবে ট্রফি জয়ের ক্ষেত্রে কোহলির অধিনায়কত্বে কিছুটা হতাশা ছিল। তিনি আইসিসির কোনো বড় শিরোপা জিততে পারেননি, যেটা অনেক সমালোচকের নজরে এসেছে। তবুও তার অধিনায়কত্বে দল গড়ার কৌশল, তরুণদের সুযোগ দেওয়া, এবং ফিটনেস সংস্কৃতি আনয়নের জন্য তার প্রশংসা করেন সবাই।
কোহলি শুধুই একজন ব্যাটসম্যান নন—তিনি এক সামাজিক আইকন। স্ত্রী অনুশকা শর্মার সঙ্গে তার সম্পর্ক ও পরিবার গঠন তাকে আরও মানবিক এক চেহারা দিয়েছে ভক্তদের চোখে। মাঠে আগ্রাসী হলেও মাঠের বাইরে তিনি শান্ত, পরিপক্ব এবং দানশীল। বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান, শিশু স্বাস্থ্য, পশু অধিকার এবং পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে কাজ করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ফলোয়ার সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে, যা তাকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাথলেটদের কাতারে নিয়ে যায়। তরুণদের কাছে তিনি একজন রোল মডেল, যারা শুধু খেলার দক্ষতাই নয়—জীবন যাপন, মানসিক দৃঢ়তা এবং শৃঙ্খলার দিক থেকেও কোহলিকে অনুসরণ করে।
২০২5 সালের মে মাসে এক আবেগঘন সংবাদ সম্মেলনে কোহলি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে আমি ভারতের হয়ে খেলেছি। এখন সময় হয়েছে নতুনদের জায়গা করে দেওয়ার। আমি কৃতজ্ঞ—ভক্তদের, পরিবারকে, এবং সেই কোচদের, যারা আমাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন।”
তার এই ঘোষণায় ভেঙে পড়েন বহু ভক্ত, সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয় আবেগের ঢল। শচীন টেন্ডুলকার, মহেন্দ্র সিং ধোনি, রিকি পন্টিং, এবি ডি ভিলিয়ার্স থেকে শুরু করে অসংখ্য কিংবদন্তি তার অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
অবসরের পর কোহলি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ক্রিকেট থেকে সরিয়ে নেবেন না বলেই ধারণা করছেন অনেকেই। ক্রিকেট বিশ্লেষক, মেন্টর বা এমনকি কোচ হিসেবেও হয়তো ভবিষ্যতে তাকে দেখা যেতে পারে। পাশাপাশি নিজের ফাউন্ডেশন এবং সামাজিক কার্যক্রমেও অধিক মনোনিবেশ করবেন তিনি। আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে খেলা চালিয়ে যেতে পারেন, যদিও সেটি নিয়েও এখনো নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি।
বিরাট কোহলির ক্যারিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধ্যায়। তিনি শুধু একজন ব্যাটসম্যানই ছিলেন না, ছিলেন এক যোদ্ধা, এক নেতা এবং এক আদর্শ। তার বিদায়ে শুধু ভারত নয়, গোটা ক্রিকেটবিশ্ব হারাল এক অনন্য নায়ককে। তবে তার রেখে যাওয়া ছাপ যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়ে।