সংসারে অভাব, বাবার অন্ধত্ব, আর্থিক অনিশ্চয়তা—এসব বাস্তবতা পার করে আজ মো. সোহেল রানা একজন গর্বিত পররাষ্ট্র ক্যাডার। একসময় রাজশাহীতে দিনে পাঁচটি টিউশন করে চলতে হয়েছে তাকে। এমনকি মাত্র ২০০ টাকাতেও টিউশন করেছেন। কষ্ট চেপে রেখে, আত্মীয়স্বজনের কটাক্ষ সহ্য করে, চোখের জল লুকিয়ে তিনি পৌঁছেছেন স্বপ্নের ঠিকানায়।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ছেলে সোহেল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ। ২০১৪ সালে বাবার ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার পর তিনি পুরো সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। অন্ধ বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য টিউশনের টাকায় নিজের পড়াশোনাসহ সংসার চালিয়েছেন।
সোহেল জানান, “টিউশনি না করলে চলত না। প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে টিউশন খুঁজেছি। তখন রাজশাহীতে ১০০-২০০ টাকার টিউশন করেও কাজ চালাতে হয়েছে।” বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের পাশাপাশি এই জীবনসংগ্রাম তাকে আরও দৃঢ়চেতা করে তোলে।
স্নাতক শেষ হওয়ার পর শুরু হয় জীবনের কঠিনতম যুদ্ধ। চাকরি না পাওয়ার হতাশা, আত্মীয়দের অবজ্ঞা, বন্ধুদের চাকরিতে সফলতা—সব মিলিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি। তবে হাল ছাড়েননি। বই কেনা, ঢাকায় যাতায়াত—সব খরচ মেটাতে হয়েছে টিউশনের আয় দিয়ে। দিনে ১০-১২ ঘণ্টা পড়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। নিজেকে বারবার গড়েছেন নতুন করে।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে, ২০২১ সালে তিনি বিসিএস প্রস্তুতিতে আরও মনোযোগী হন। প্রথমে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। এরপর ৪৪তম বিসিএসে নিজের স্বপ্নের গন্তব্য—পররাষ্ট্র ক্যাডারে জায়গা করে নেন। দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ এই অর্জন।
নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে সোহেল বলেন, “অনেকদিন ধরেই পররাষ্ট্র ক্যাডারে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। আল্লাহর রহমতে সেটি পূরণ হয়েছে। বাবা-মা, স্ত্রী, বন্ধু—সবাই অনেক খুশি।” তিনি জানান, ভবিষ্যতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য কাজ করতে চান। যাতে বিদেশে চাকরি ও যাতায়াত আরও সহজ হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
একসময় বই কেনার টাকায় টান পড়লে যিনি কেঁদে ফেলতেন, আজ তিনি হাজারো তরুণের অনুপ্রেরণা। তরুণদের উদ্দেশে তার বার্তা—“সফলতা চাই বললেই হয় না, এর জন্য দরকার কঠোর পরিশ্রম, ডেডিকেশন ও আত্মবিশ্বাস। দিনে অন্তত ৮-১০ ঘণ্টা পড়াশোনা না করলে বিসিএসে টিকে থাকা কঠিন।”
সোহেল রানার এই গল্প প্রমাণ করে—আর্থিক দৈন্যতা নয়, স্বপ্ন, সাহস আর পরিশ্রমই মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের চূড়ায়।