ভালোবাসা, সংগ্রাম আর স্বপ্নের আরেক নাম—উল্লাস পাল। জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিল তার জীবনের অংশ। কিন্তু সেই প্রতিবন্ধকতা কখনোই তার স্বপ্নকে থামাতে পারেনি। জীবনের প্রতিটি ব্যথা, প্রতিটি সীমাবদ্ধতা আর কষ্টকে শক্তিতে রূপান্তর করে আজ তিনি পৌঁছে গেছেন তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায়—বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে। তার এই অর্জন শুধু তার নিজের নয়, এটি প্রত্যেক সেই তরুণ-তরুণীর জয়, যারা জীবনের প্রতিকূলতার মাঝেও লড়াই করে বাঁচতে শিখেছে।
উল্লাস পালের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামে। বাবা উত্তম কুমার পাল একজন মৃৎশিল্পী এবং মা আন্না রানী পাল একজন গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে উল্লাসই বড়। জন্মের সময় থেকেই তার দুই হাত ও পা বাঁকা ছিল। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেননি। বাবা-মায়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ভারতে নিয়ে তার এক পায়ের অস্ত্রোপচার করা হয়, যার ফলে তিনি সীমিতভাবে হাঁটাচলা করতে সক্ষম হন।
১৯৯৯ সালে কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন উল্লাস। বর্ষার দিনে কাদা মাড়িয়ে স্কুলে যাওয়া ছিল খুব কষ্টকর। প্রতিদিন বাবার কোলে করেই স্কুলে যেতেন। বাঁ হাতে লেখার অভ্যাস গড়ে তোলেন শৈশব থেকেই। খেলার মাঠে নামতে না পারলেও ফুটবল খেলোয়াড়দের প্রতি ছিল তার অপার আগ্রহ।
২০১০ সালে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেন তিনি। এরপর ঢাকার নর্দান কলেজে পড়াশোনা করে ২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষাও কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০১৬ সালে বিবিএ ও পরে এমবিএ সম্পন্ন করেন।
উল্লাসের লক্ষ্য ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়া। সেই লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। অংশ নেন ৪০তম, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে। ৪০তম বিসিএস পাস করলেও পদ পাননি, ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। এরপর ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পেয়ে নড়িয়া সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল প্রশাসন ক্যাডার হওয়া। সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পায় ৪৪তম বিসিএসে, যেখানে তিনি প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
এলাকাবাসীর কাছে উল্লাস এখন এক গর্বের নাম। প্রতিবেশী রূপক পাল বলেন, “উল্লাস প্রমাণ করেছে প্রতিবন্ধী মানেই বোঝা নয়, বরং সাহস আর মেধায় সে আমাদের গর্ব।” তার মা বলেন, “ছেলেটা ছোট থেকেই সংগ্রাম করে বড় হয়েছে, আজ সে প্রশাসন ক্যাডারে—এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।” বাবা উত্তম কুমার পাল জানান, “ওর লেখাপড়ার প্রতি ভালোবাসা দেখে সব সময় পাশে থেকেছি, সাহস দিয়েছি। আজ সেই সাহস তার জীবন বদলে দিয়েছে।”
নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে উল্লাস বলেন, “যখন রেজিস্ট্রেশন নম্বর মিলিয়ে দেখলাম আমি প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি, তখন আনন্দের অশ্রু থামানো যায়নি। অনেকে আমাকে বলেছে, আমি পারব না। আমি দমে যাইনি। আজ প্রমাণ হয়েছে, ইচ্ছাশক্তিই সব।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার আমাকে যেখানেই দায়িত্ব দিক, আমি নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করব। সব সময় মানুষের পাশে থাকতে চাই। শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা কোনো অভিশাপ নয়—সমাজ যদি একটু পাশে থাকে, তাহলেই তারা এগিয়ে যেতে পারে। করুণা নয়, আমি চাই সমাজ যেন সম্মানের চোখে আমাদের দেখে।”
কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ বলেন, “শারীরিকভাবে একটু সমস্যা ছিল, কিন্তু মেধায় ছিল অসাধারণ। তার এই সাফল্যে আমরা খুবই আনন্দিত।”