ইংরেজ শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার বড়লাট হয়েও কখনও ভুলে যাননি তার দুঃসময়ের বন্ধু কৃষ্ণকান্ত নন্দীকে। হেস্টিংস তাকে বানিয়া বা কমার্শিয়াল অ্যাজেন্ট হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং তার থেকেই ঋণ গ্রহণ করতেন। অথচ কৃষ্ণকান্তের সঙ্গে হেস্টিংসের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল এক অনন্যসাধারণ ঘটনার মাধ্যমে—যেখানে পান্তা ভাত আর কুচো চিংড়ি দিয়ে এক ইংরেজ কর্মকর্তার মন জয় করেছিল এক সাধারণ বাঙালি পরিবার।
ঘটনা ১৭৫৬ সালের। নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে ইংরেজ বণিকেরা চুক্তি ভঙ্গ করে কাশিমবাজার ও কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ শুরু করলে নবাব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ইংরেজদের অবাধ্যতায় ক্ষুব্ধ সিরাজ কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠি অবরোধ করে ফেলেন এবং প্রধান কর্মকর্তা ওয়াটস আত্মসমর্পণ করেন। এর ফলে অনেক ইংরেজ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার বন্দী হন। তাদের একজন ছিলেন পরবর্তী সময়ে বাংলার গভর্নর জেনারেল হওয়া ওয়ারেন হেস্টিংস।
হেস্টিংসের মুক্তির জন্য কাশিমবাজারের ডাচ কুঠির ভার্নেট সিরাজের কাছে অনুরোধ করলে নবাব সম্মানবোধে তাকে মুক্তি দেন। কিন্তু হেস্টিংস এরপর গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত হলে তা ফাঁস হয়ে যায় এবং সিরাজ আবারো তাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। বিপদের মুখে পড়ে হেস্টিংস আশ্রয় নেন তার পুরনো বন্ধু কৃষ্ণকান্ত নন্দীর কাছে।
প্রথমে এক মুদি দোকানে এবং পরে কৃষ্ণকান্তের বাড়িতে লুকিয়ে রাখা হয় হেস্টিংসকে। সে সময় কোন উপযুক্ত খাবার না থাকায় তাকে দেওয়া হয় পান্তা ভাত, কুচো চিংড়ি, কাঁচা লঙ্কা ও বড়ি ভাজা। এই সাধারণ খাবারই হয়ে ওঠে হেস্টিংসের প্রাণরক্ষার মাধ্যম এবং পরে স্মৃতির অতলে প্রোথিত হয়ে যায়। তিনি গভর্নর জেনারেল হওয়ার পরেও নিয়মিতভাবে এই খাবার খেতেন।
ওই সময় হেস্টিংসকে নিয়ে লোকমুখে একটি ছড়া প্রচলিত হয়েছিল:
হেস্টিংস সিরাজ ভয়ে হয়ে মহাভীত
কাশিমবাজারে গিয়া হন উপনীত।
…
ঘরে ছিল পান্তাভাত আর চিংড়ি মাছ
কাঁচা লঙ্কা, বড়ি পোড়া, কাছে কলাগাছ।
সূর্যোদয় হলো আজি পশ্চিম গগনে
হেস্টিংস ডিনার খান কান্তের ভবনে।
কৃষ্ণকান্ত পরে শুধু বন্ধু নন, হয়ে ওঠেন এক ধনী ও প্রভাবশালী জমিদার। বাংলাপিডিয়া জানায়, হেস্টিংসের পত্তনী ব্যবস্থায় তিনি গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বহু জমিদারির মালিক হন। এমনকি নাটোরের রানি ভবানীর কিছু সম্পত্তি হেস্টিংস কৃষ্ণকান্তকে দিয়ে দেন। তার অর্থসম্পদ ও প্রভাব এতটাই বেড়ে যায় যে কাশিমবাজারে তিনি ‘রাজা’ উপাধি পান।
হেস্টিংসের সুপারিশে তার উত্তরসূরি স্যার ফ্রান্সিস সাইকসও কৃষ্ণকান্তকে বানিয়া হিসেবে নিয়োগ করেন। এভাবে পান্তা ভাত শুধু একজন ইংরেজ শাসকের মন জয় করেনি, বরং বদলে দিয়েছিল একজন বাঙালির ভাগ্যও।