ধর্মীয় বিভাজনের কঠিন সময়ে, ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুণে শহরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক হৃদয়স্পর্শী ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। এই ঘটনার ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়ে উঠেছে সম্প্রীতি, সহানুভূতি ও মানবিকতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে। অনেকেই একে ‘নতুন ভারতের মুখ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন—যেখানে ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ একে অপরের পাশে দাঁড়ায়।
ঘটনাটি ঘটে পুণের ওয়ানাওয়াড়ি এলাকার স্টেট রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (SRPF) মাঠসংলগ্ন অলংকরণ লনে। সেদিন সন্ধ্যা ৬টা ৫৬ মিনিটে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সংস্ক্রুতি কাওয়াড়ে ও নরেন্দ্র গালান্ডে নামের এক হিন্দু যুগলের বহু প্রতীক্ষিত বিবাহ অনুষ্ঠান। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল—মঞ্চ সাজানো, পুরোহিত উপস্থিত, অতিথিরাও ভিড় জমাতে শুরু করেছেন। ঠিক তখনই শুরু হয় আকস্মিক ভারী বৃষ্টি, যা নিমিষেই অনুষ্ঠানস্থলকে জলমগ্ন করে ফেলে। অতিথিরা দিশেহারা হয়ে ছুটতে থাকেন আশ্রয়ের খোঁজে, আর পরিবারের সদস্যরা হতাশায় ভেঙে পড়েন।
এই সংকটময় মুহূর্তে কাওয়াড়ে পরিবারের দৃষ্টি পড়ে পাশের একটি ব্যাংকোয়েট হলের দিকে, যেখানে মুসলিম পরিবার কাজী সাহেবের ছেলে মহসিন ও পাত্রী মাহিনের ওয়ালিমা (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান) চলছিল। হিন্দু পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা এগিয়ে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করলে, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ফারুক কাজী বিনা দ্বিধায় ব্যাংকোয়েট হলের একটি অংশ তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। শুধু স্থান নয়, তিনি এবং তার পরিবার ও অতিথিরা হিন্দু বিয়ের আয়োজন সফল করতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেন।
এরপর ঘটে এক মানবিকতার দৃশ্য—একই মঞ্চে প্রথমে হিন্দু বিবাহ সম্পন্ন হয়, পরে মুসলিম ওয়ালিমা অনুষ্ঠানও সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। উভয় ধর্মের অতিথিরা একে অপরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, একসঙ্গে খাবার খান, ছবি তোলেন এবং রাতভর আনন্দে মেতে ওঠেন। এক অভূতপূর্ব মিলনমেলায় পরিণত হয় সেই রাত, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক স্থায়ী প্রতীক হয়ে উঠে।
এই ঘটনা সম্পর্কে আইনজীবী ও কাওয়াড়ে পরিবারের বন্ধু অ্যাডভোকেট নীলেশ শিন্ডে বলেন, “প্রথমে ভাবছিলাম বৃষ্টি অল্প সময়েই থেমে যাবে, কিন্তু যখন দেখলাম পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, তখন সাহায্যের জন্য পাশে থাকা মুসলিম পরিবারের দ্বারস্থ হই। তারা তাদের নিজেদের আনন্দের মুহূর্ত ভুলে গিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ায়।”
সংস্ক্রুতির ঠাকুরদাদা সান্তারাম কাওয়াড়ে বলেন, “দুই মাস ধরে আমরা যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, বৃষ্টিতে তা ধ্বংস হয়ে যাবে ভেবে মনটা ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু কাজী পরিবারের সহানুভূতিতে আমরা নতুন করে আশার আলো দেখতে পাই।”
বাবা চেতন কাওয়াড়ে বলেন, “আমাদের মেয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনে মুসলিম পরিবার যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে, তা কেবল উদারতা নয়, এটি মানবতার এক অনন্য উদাহরণ।”
অন্যদিকে ফারুক কাজী জানান, “আমি যখন দেখলাম তাদের অনুষ্ঠান ভেস্তে যাচ্ছে, তখন মনে হলো ওরাও তো আমার মেয়ের মতোই। এক বাবার হৃদয় থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পাশে থাকার।”
এই অসাধারণ রাতটি দুই পরিবার ও দুই নবদম্পতির জন্য রয়ে গেছে স্মরণীয় এক অধ্যায় হিসেবে। তাদের হাসিমুখে তোলা ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে—যা বার্তা দিচ্ছে, বিভাজনের সময়েও সম্প্রীতির শক্তিই সবচেয়ে বড় আশ্রয়।