গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ কোনো না কোনোভাবে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি নিজেদের জনগণের খাদ্য চাহিদা পূরণেও বেশিরভাগ দেশকে আমদানির দিকে ঝুঁকতে হয়। তবে এর ব্যতিক্রম হয়ে চমক সৃষ্টি করেছে দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট দেশ গায়ানা।
সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১৮৬টি দেশের মধ্যে একমাত্র গায়ানাই এমন একটি দেশ, যা খাদ্যে পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার ফুড’ নামক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, গায়ানায় ফলমূল, সবজি, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য, উদ্ভিজ্জ প্রোটিন এবং শর্করার উৎস—এই সাতটি প্রধান খাদ্য উপাদানই দেশটির নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমে জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে সক্ষম। উর্বর মাটি, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও অনুকূল জলবায়ুর কারণে দেশটিতে কৃষিকাজ সহজ ও কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়।
প্রায় ৮ লাখ জনসংখ্যা এবং বিস্তৃত কৃষিজমির কারণে গায়ানা খাদ্য উৎপাদনে এক অনন্য সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। গবেষকদের মতে, দেশটির কৃষি খাত দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, ফলে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানেই তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে।
এই গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছে জার্মানির গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তারা প্রতিটি দেশের খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ এবং নাগরিকদের পুষ্টির চাহিদা মূল্যায়ন করেছেন বিশ্ব প্রকৃতি তহবিলের (WWF) ‘লাইভওয়েল ডায়েট’ অনুযায়ী।
বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, বিশ্বের প্রায় ৬৫ শতাংশ দেশ মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনে এগিয়ে থাকলেও উদ্ভিজ্জ প্রোটিন ও শর্করার উৎসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাদ্য উপাদানে বড় ঘাটতি রয়েছে। মাত্র ২৪ শতাংশ দেশ পর্যাপ্ত সবজি উৎপাদনে সক্ষম এবং আরও কমসংখ্যক দেশ সফল হয়েছে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন উৎপাদনে।
গায়ানার পর সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে চীন ও ভিয়েতনাম, যারা সাতটির মধ্যে ছয়টি খাদ্য উপাদানে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে সার্বিকভাবে দেখা যায়, প্রতি সাতটি দেশের মধ্যে মাত্র একটি দেশই পাঁচটির বেশি খাদ্য উপাদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
অন্যদিকে, ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশ খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকলেও ছোট দ্বীপরাষ্ট্র, আরব উপসাগরীয় দেশ এবং নিম্ন-আয়ের বহু দেশ এখনো ব্যাপকভাবে খাদ্য আমদানির উপর নির্ভরশীল।
গবেষণায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, ম্যাকাও, কাতার ও ইয়েমেন—যারা কোনো একটি খাদ্য উপাদানেও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
গবেষণার প্রধান লেখক ড. জোনাস স্টেহল উল্লেখ করেন, “খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা না থাকলেই যে তা নেতিবাচক কিছু, তা নয়। অনেক দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ খাদ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে দক্ষ উৎপাদক দেশ থেকে আমদানি করাই হতে পারে কার্যকর সমাধান।”
তবে তিনি সতর্ক করে আরও বলেন, “স্বয়ংসম্পূর্ণতা না থাকলে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সামান্য অস্থিরতাও—যেমন যুদ্ধ, খরা বা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা—কোনো দেশের জন্য ভয়াবহ সংকট ডেকে আনতে পারে।”