ছোটবেলায় আমরা অনেকেই শুনেছি—‘আস্তে খাও’, ‘ভালো করে চিবিয়ে খাও’, ‘খাওয়ার সময় কথা বলো না’। এসব উপদেশ যে কেবল ভদ্র আচরণ নয়, বরং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গঠনে সহায়ক, তা এখন বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত। পুষ্টিবিদ তাসনিম চৌধুরী এবং খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ লেসলি হেইনবার্গের মতে, ধীরে ধীরে ও মনোযোগ দিয়ে খাওয়া আমাদের হজম, মস্তিষ্ক-পাকস্থলী সংযোগ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পেট ভরার সংকেত ও সময়ের ভূমিকা
আমাদের পাকস্থলী থেকে মস্তিষ্কে “পেট ভরে গেছে” এই সংকেত পৌঁছাতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। কেউ যদি এর কম সময়ে খাওয়া শেষ করে ফেলে, তাহলে মস্তিষ্ক সেই সংকেত পাওয়ার আগেই অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে যায়। ধীরে খেলে পেট বেশিক্ষণ ভরা থাকে, খাবার চাওয়ার প্রবণতা কমে, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
দ্রুত খাওয়ার কারণ ও ঝুঁকি
দ্রুত খাওয়ার পেছনে ব্যস্ততা, মানসিক চাপ, দীর্ঘ সময় না খাওয়া বা কঠোর ডায়েটের ভূমিকা থাকে। এর ফলে আমরা খাবার উপভোগ না করেই গিলে ফেলি, যার ফলে হজমে সমস্যা, পেট ভার, বুক জ্বালাপোড়া এবং গ্যাসের সমস্যাসহ নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দেয়।
হজম ও বিপাকীয় সমস্যাগুলো
খাবার ভালোভাবে না চিবিয়ে খেলে তা বড় টুকরো আকারে পাকস্থলীতে পৌঁছায়। এতে হজমে অসুবিধা হয় এবং পরিপাকতন্ত্রে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। ফলে বিপাকীয় ব্যাধি, যেমন অ্যাসিডিটি, গ্যাস্ট্রিক, ওজন বৃদ্ধি এবং হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
ওজন বৃদ্ধি ও গবেষণালব্ধ প্রমাণ
হারবার্ড হেলথ পাবলিকেশন্সের এক গবেষণায় জানা যায়, দ্রুত খাওয়া মানুষদের দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণ বেশি হয়। গ্রিসে করা আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ধীরে খাওয়া দলের শরীর এমন এক হরমোন নিঃসরণ করে যা পেট ভরা অনুভূতি দেয়। চীনের এক জাতীয় গবেষণায়ও দেখা যায়, শিশুদের স্থূলতার পেছনে দ্রুত খাওয়ার ভূমিকা রয়েছে। পাঁচ বছরব্যাপী এক গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রুত খাওয়া মানুষের স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি ১১ শতাংশ বেশি।
অম্লভাব ও হার্টবার্ন
দ্রুত খাওয়ার ফলে অতিরিক্ত বাতাস গেলার প্রবণতা দেখা দেয়, এতে পেট ফুলে অস্বস্তি হয়। একইসঙ্গে বেশি খাওয়ার কারণে পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি হয়ে বুক জ্বালাপোড়া বা হার্টবার্ন হয়।
পুষ্টি শোষণে ঘাটতি
পুষ্টিবিদদের মতে, দ্রুত খাওয়ার ফলে খাবার সঠিকভাবে ভাঙা ও হজম না হওয়ায় দেহ পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে না। ফলে আপনি পুষ্টিকর খাবার খেলেও সেগুলোর ভিটামিন ও মিনারেল শরীরের উপকারে আসে না।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন সমস্যাও যুক্ত
জাপানের এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা ১০ মিনিটের মধ্যে খাবার শেষ করেন তাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ খুব দ্রুত বেড়ে যায়। একই খাবার ধীরে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম থাকে। দ্রুত খেলে ইনসুলিন নিঃসরণ কমে যায়, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একটি প্রধান কারণ।
কীভাবে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন
খাবারের জন্য সময় নির্দিষ্ট করুন, অন্তত ৩০ মিনিট। প্রতিটি গ্রাস ১৫ থেকে ৩০ বার চিবিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন। প্রতিবার চামচ বা হাত নামিয়ে বিরতি নিন। খাবার শুকনো হলে একটু পানি পান করুন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—মাইন্ডফুল ইটিং। অর্থাৎ খাওয়ার সময় শুধু খাবারেই মনোযোগ দিন। এর গন্ধ, রং, গঠন, স্বাদ এবং চিবানোর অনুভূতি পুরোপুরি উপলব্ধি করুন। এতে করে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং খাবার উপভোগ্যও হবে।