বিশ্বব্যাপী ২০০ কোটিরও বেশি মুসলমান প্রতি বছর উদযাপন করে ঈদুল আযহা, যা কেবলমাত্র একটি উৎসব নয়, বরং আত্মত্যাগ, সমবেদনা এবং মানবিকতার এক অনন্য প্রতীক। এই পবিত্র উৎসবটি হজের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয়, যার শিকড় বহু হাজার বছর আগেকার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে জড়িয়ে আছে। ঈদুল আযহার মূল উৎস ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই অগাধ বিশ্বাস ও আনুগত্যের কাহিনীতে নিহিত, যখন তিনি আল্লাহর আদেশে নিজের প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা পরীক্ষার চূড়ান্ত মুহূর্তে ইসমাঈলের পরিবর্তে একটি পশু প্রেরণ করেন, যা মুসলিম বিশ্বের কোরবানির প্রথার সূচনা হিসেবে প্রতীকী হয়ে ওঠে। এই ঘটনাটি শুধু ইসলামী ইতিহাসেরই নয়, বিশ্ব ধর্ম ও মানবতার ইতিহাসেরও এক মূল্যবান অংশ হিসেবে বিবেচিত।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ঈদুল আযহা উদযাপন করা হয়, যেখানে প্রতিটি দেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক রঙ ফুটে ওঠে। সৌদি আরবে, যেখানে লাখো হাজি মিনা মরুভূমিতে পশু কোরবানি দেন, সেই সঙ্গে এই উৎসবের সময়কাল হজের সাথে যুক্ত। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও মিশরসহ বিভিন্ন দেশের মুসলমানেরা নিজেদের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি অনুসরণ করে ঈদ উদযাপন করে থাকে। প্রবাসী মুসলমানরাও নিজেদের দেশের সংস্কৃতি বজায় রেখে নানা কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ ও বাড়িতে মিলিত হয়ে ঈদের জামাত আদায়, মিলাদ ও কোরবানি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনন্দ ভাগাভাগি করে থাকেন। প্রবাসেও ঈদ উপলক্ষে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একতার ও সৌহার্দ্যের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।
বাংলাদেশে ঈদুল আযহা মানেই প্রাণচাঞ্চল্যপূর্ণ কোরবানির হাট, যেখানে গরু, ছাগল এবং কখনো উটও দেখা যায়। শহর হোক বা গ্রাম, সবাই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি দেয় এবং কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে আত্মীয়, গরিব ও নিজের পরিবারের মাঝে বিতরণ করে। ঈদুল আযহারের মূল শিক্ষা হলো আত্মত্যাগ, সহানুভূতি ও মানবতা। এই দিনে ধনী ও গরিব নির্বিশেষে সবাই একই সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে, যা সমাজের মধ্যে সাম্য ও ঐক্যের প্রতীক। কোরবানির মাধ্যমে গরিব ও দুঃখীদের মুখে হাসি ফুটানো হয়, যা সমাজে দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার বার্তা বহন করে। এই উৎসব আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ধৈর্যের শিক্ষা দেয়, বিশেষত পরীক্ষার মুহূর্তে।
ঈদুল আযহা উপলক্ষে মুসলিম সমাজে দান-শীলতা ও সামাজিক বন্ধুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা প্রদান এই উৎসবের অপরিহার্য অংশ। এই দান-শীলতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ ও মৈত্রী বাড়ায়। শিশুদের মধ্যে ঈদের আনন্দ বন্টন করা, বৃদ্ধ ও অসহায়দের খুশি করার মাধ্যমে একটি মানবিক সমাজ গঠনে সাহায্য করে।
প্রবাসে থেকেও হাজার মাইল দূরে থাকা বাংলাদেশিরা ঈদের দিন নিজেদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখে। ইসলামিক সেন্টার, কমিউনিটি হল বা ঘরোয়া পরিবেশে ঈদের জামাত, কোরবানি ও আনন্দ-উৎসব পালন করে তারা নিজেদের শেকড়ের টান অনুভব করেন। ঈদ মানেই পরিবারের সঙ্গে সংযোগ, ভালোবাসা এবং ঐক্যের বার্তা।
ঈদুল আযহা শুধুমাত্র পশু কোরবানির উৎসব নয়; এটি আত্মত্যাগ, মানবতা, সমতা ও ভালোবাসার এক মহৎ বার্তা বহন করে। আপনি যেখানেই থাকুন, এই পবিত্র দিনে চলুন আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়াই, সহানুভূতি ছড়িয়ে দিই এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাই। এই মহান দিনে আমাদের মন ও জীবনে মানবতার দীপ জ্বালিয়ে রাখাই ঈদের আসল প্রাপ্তি।
ডাব্লিউডব্লিউএনএন-এর পক্ষ থেকে দেশ-বিদেশের সকল দর্শক, প্রিয় প্রবাসী বাংলাদেশি ভাই-বোন ও মুসলিম উম্মাহকে জানাই—পবিত্র ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক!“