জীবনে অনেক সময় আমরা শুনি—”লোকটা হঠাৎ করেই মারা গেল!” কেউ হয়তো ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন, কেউ আবার নামাজ পড়ার সময় বা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ লুটিয়ে পড়েছেন। এসব ঘটনাকে আমরা হঠাৎ মৃত্যু হিসেবে দেখি, যেখানে কোনো পূর্বসঙ্কেত থাকে না। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, হঠাৎ মৃত্যুর পেছনে থাকে নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক ব্যর্থতা। এর মধ্যে হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাগুলো সবচেয়ে বেশি দায়ী।
হৃদরোগ: নিঃশব্দ ঘাতক
হৃদপিণ্ড আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে শরীরের প্রত্যেকটি কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। হার্টে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী যদি ব্লক হয়ে যায়, তাহলে অক্সিজেনের ঘাটতির ফলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এমন ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই যদি চিকিৎসা না করা হয়, রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. খান আবুল কালাম আজাদের মতে, হঠাৎ মৃত্যুর পেছনে “কার্ডিয়াক ফেইলিউর” বা “রেস্পিরেটরি ফেইলিউর” — এই দুটি কারণ প্রধান। হৃদস্পন্দন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, হার্টের পেশী অকার্যকর হয়ে যাওয়া, কিংবা ধমনীতে ব্লক হলেই মৃত্যু হতে পারে।
বিশ্বখ্যাত ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক জানায়, হার্ট অ্যাটাকের সময় দ্রুত CPR (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) দেওয়া হলে রোগীর প্রাণ ফিরে আসার সম্ভাবনা বাড়ে। সিপিআর এমন একটি জরুরি চিকিৎসা পদ্ধতি, যা জ্ঞান হারানো বা শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া রোগীর ক্ষেত্রে দ্রুত প্রয়োগযোগ্য।
রেস্পিরেটরি ফেইলিউর: অক্সিজেন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে
শ্বাসতন্ত্রের ব্যর্থতা, বা রেস্পিরেটরি ফেইলিউর, হঠাৎ মৃত্যুর আরেকটি সাধারণ কারণ। এতে শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় অথবা কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করতে পারে না। লক্ষণগুলো হলো: শ্বাসকষ্ট, ঠোঁট-আঙুল নীল হওয়া, অতিরিক্ত ঘাম, বিভ্রান্তি, মাথাব্যথা ইত্যাদি।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। চিকিৎসকরা বলেন, ছয় মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা গেলে জীবন রক্ষা সম্ভব। তবে বাস্তবে এত দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো কঠিন, ফলে অনেক রোগী হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যান।
পালমোনারি এম্বোলিজম: নীরব অথচ প্রাণঘাতী ব্লকেজ
ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধা বা পালমোনারি এম্বোলিজমও হঠাৎ মৃত্যুর একটি বড় কারণ। ফুসফুসের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধলে তা হার্ট ও ফুসফুসের কার্যকারিতা ব্যাহত করে এবং মুহূর্তেই প্রাণহানি ঘটাতে পারে।
লক্ষণগুলো হলো: হঠাৎ শ্বাস নিতে সমস্যা, বুক ব্যথা, ঘাম হওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। যাদের ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ রয়েছে বা পরিবারে এই রোগের ইতিহাস আছে, তাদের ঝুঁকি বেশি। বয়স ৬০ বছরের বেশি হলে কিংবা অতিরিক্ত ওজন থাকলেও সতর্ক থাকতে হবে।
স্ট্রোক: মস্তিষ্কে অক্সিজেন না পৌঁছানোই কাল হতে পারে
স্ট্রোক মানেই মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া বা রক্তনালী ফেটে যাওয়া। এতে মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন না পেয়ে নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে হেমোরেজিক স্ট্রোক হঠাৎ মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
স্ট্রোকের লক্ষণ: শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, তীব্র মাথাব্যথা, ভারসাম্য হারানো, বমি, খিঁচুনি ইত্যাদি। এসব লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরি। দেরি করলে মৃত্যু অনিবার্য হতে পারে।
প্রতিরোধই প্রধান হাতিয়ার
হঠাৎ মৃত্যুর প্রতিটি কারণের পেছনে থাকে একটি সাধারণ সমাধান— সুশৃঙ্খল জীবনযাপন। চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন, ব্যালান্সড ডায়েট, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান-মদ্যপান বর্জন, মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাই হতে পারে হঠাৎ মৃত্যুর প্রধান প্রতিরোধক ব্যবস্থা।
দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে অনেক রোগী শেষ মুহূর্তে চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ শুরুতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে অনেক মৃত্যুই এড়ানো যেত। তাই আগেভাগে সচেতন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।