এটি কল্পবিজ্ঞান নয়—বরং উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রযুক্তিভিত্তিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইসা) তাদের সাম্প্রতিক ‘টেকনোলজি ২০৪০’ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আর মাত্র ১৫ বছরের মধ্যেই মঙ্গলে গড়ে উঠবে “স্পেস ওয়েসিস” বা ‘মহাকাশ মরুদ্যান’।
এই মহাকাশ মরুদ্যান হবে কাঁচে মোড়া সবুজ ঘর, তাপপ্রতিরোধী গম্বুজে গৃহস্থালি জীবন, রোবট দ্বারা পরিচালিত অনুসন্ধান ব্যবস্থা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃত্রিম উপগ্রহে গঠিত এক ‘মঙ্গল-সভ্যতা’। এখানেই থেমে থাকছে না পরিকল্পনা—চাঁদ এবং পৃথিবীর কক্ষপথেও একই ধরনের গম্বুজ বসবাসের পরিবেশ তৈরি করা হবে।
এই গম্বুজগুলো হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানে উৎপাদিত হবে বিদ্যুৎ, চাষ হবে শাকসবজি ও ফলমূল, পুনর্ব্যবহৃত হবে পানি ও বর্জ্য। কাঁচের ছাদের নিচে আলু, টমেটো, চাল, মাশরুমসহ নানা ফসল ফলানো হবে। ফিফার নিয়ম অনুসারে রোবট পরিচালিত সুরক্ষা ব্যবস্থাও থাকবে, যা মহাজাগতিক ঝড়, গ্রহাণু কিংবা ধুলোর ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দেবে।
এছাড়া, ভবিষ্যতের মহাকাশ স্টেশন, যন্ত্রপাতি, ও মহাকাশযানও নির্মিত হবে মঙ্গল, চাঁদ কিংবা মহাকাশেই। ইন-সিচু ম্যানুফ্যাকচারিং (স্থানীয় উপাদানে নির্মাণ) এবং রোবটিক অ্যাসেম্বলি ব্যবহার করে গড়ে তোলা হবে এসব কাঠামো। এমনকি মহাকাশে থাকা পরিত্যক্ত উপগ্রহ, ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি পুনঃব্যবহার করে গড়ে উঠবে ‘সার্কুলার স্পেস ইকোনমি’।
ইসার পরিকল্পনায় রয়েছে সৌরজগতব্যাপী ইন্টারনেট গড়ে তোলা, যেখানে অটোনোমাস নেটওয়ার্ক এবং অপটিক্যাল সিগন্যালের মাধ্যমে পৃথিবী, মঙ্গল, চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব হবে। ঠান্ডা অঞ্চলে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করা হবে পারমাণবিক শক্তি ও শক্তিশালী ব্যাটারি প্রযুক্তি।
মঙ্গলে পানির অস্তিত্ব এখনো আছে—তবে তা জমাটবাঁধা অবস্থায়। মঙ্গলের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে দুই মাইল গভীরে রয়েছে বরফস্তর, যা গলিয়ে কৃষিকাজ ও পানীয় জলের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তবে এর জন্য দরকার বিশাল মাপের খননযন্ত্র ও শক্তি উৎপাদনের প্রযুক্তি।
তবে প্রযুক্তির পাশাপাশি মানুষের মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতিও জরুরি। দীর্ঘ সময় মহাকাশে বসবাসের জন্য প্রয়োজন ‘কগনিটিভ সাপোর্ট’ তথা মানসিক সহায়তা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা, রিয়েলটাইম হেলথ মনিটরিং এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি নির্ভর পুনর্বাসন ব্যবস্থা।
আজ পর্যন্ত মানুষ সবচেয়ে দূরবর্তী যাত্রা করেছে চাঁদের কক্ষপথে, মাত্র ২ লাখ ৪৮ হাজার মাইল দূরে। কিন্তু মঙ্গল পৃথিবী থেকে গড়ে ১৪ কোটি মাইল দূরে। তবুও ইসা দেখিয়ে দিয়েছে—মহাকাশ আর সীমান্ত নয়, বরং এক নতুন ভূখণ্ড। সেখানে মানুষ শুধু পৃথিবীবাসী নয়, বরং বহুগ্রহের নাগরিক হয়ে উঠবে।
এটি কেবল একটি বৈজ্ঞানিক কল্পনা নয়, বরং মানবজাতির টিকে থাকার এক বাস্তব কৌশল। যদি পরিকল্পনা মতো সবকিছু এগোয়, তবে ২০৪০ সালের মধ্যেই আমরা দেখতে পাব—মঙ্গলের বুকে জ্বলে উঠেছে আলোর গম্বুজ, চাষ হচ্ছে সবুজ ফসল, আর রোবটিক অনুসন্ধানকারীরা খুঁজে চলেছে মহাবিশ্বের নতুন রহস্য।