ভাবুন তো, শরীরের কোনো অঙ্গ কেটে গেলে সেটি আবার আগের মতো নিজে থেকেই গজিয়ে উঠছে—এ যেন গল্পের মতো শোনালেও, বিজ্ঞান আজ সেই কল্পনাকেই বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে এগোচ্ছে। চীনা বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ইঁদুরের কানে তৈরি হওয়া ক্ষত পুনরায় নতুন করে গজিয়েছে, এমনকি ভেতরের কার্টিলেজসহ! এই সাফল্য প্রমাণ করেছে, অঙ্গ পুনর্জন্ম আর শুধু কল্পনা নয়, এটি এক বাস্তব সম্ভাবনা।
এই যুগান্তকারী গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী Science-এ। গবেষণায় দেখা গেছে, ইঁদুরের কানের পুনর্গঠনের পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ ‘জেনেটিক সুইচ’। বিজ্ঞানীরা সফলভাবে সেই সুইচ অন করে ক্ষত পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া সক্রিয় করেছেন।
গবেষণার অন্যতম গবেষক ওয়াং ওয়ে, যিনি বর্তমানে বেইজিংয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিকাল সায়েন্সে সহকারী গবেষক হিসেবে কাজ করছেন, বলেন—“আমরা খুঁজে বের করতে চাচ্ছি, কীভাবে ইঁদুররা বিবর্তনের পথে এই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে আছে বিশেষ কোনো জৈবিক কারণ।”
গবেষণায় উঠে এসেছে, অঙ্গ পুনর্জন্মের মূল নিয়ামক একটি রাসায়নিক উপাদান—রেটিনয়িক অ্যাসিড, যা তৈরি হয় ভিটামিন-এ থেকে। এটি শরীরের কোষকে নির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেয় কোন কোষ কোথায় গঠিত হবে। এই অ্যাসিড তৈরির পেছনে কাজ করে একটি নির্দিষ্ট জিন, যা বিজ্ঞানীদের বহুবার পরীক্ষা করে অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেছে।
তিন বছর ধরে গবেষণা চালান ওয়াং ও তার দল। বহু জিন পরীক্ষা করে অনেকবার ব্যর্থ হলেও তারা হাল ছাড়েননি। কেউ কেউ এমন জিনও পেয়েছেন, যা ক্ষত সারানোর পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে দেয়। অবশেষে তারা এমন একটি জিনের সন্ধান পান, যা রেটিনয়িক অ্যাসিড তৈরিতে সক্ষম এবং অঙ্গ পুনর্জন্মে কার্যকর।
এই গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে স্টেরিও-সিক নামের অভিনব প্রযুক্তি, যাকে গবেষকেরা বলেন ‘জীবনের ক্যামেরা’। এটি কোষের ছবি ধারণের পাশাপাশি বুঝতে পারে কোন জিন কখন, কীভাবে কাজ করছে। সহ-গবেষক ডেং জিচিং, যিনি বিজিআই রিসার্চের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বলেন—“এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা প্রতিটি ধাপে কী ঘটছে, তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছি। যেন পুরো অঙ্গ পুনর্জন্মের মানচিত্র খুলে গেছে আমাদের সামনে।”
তবে মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ এখনো সময়সাপেক্ষ। কারণ, মানব অঙ্গ যেমন হৃদপিণ্ড, লিভার বা মেরুদণ্ড অত্যন্ত জটিল এবং বৃহৎ। প্রতিটি অঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন সংকেত ব্যবস্থা কাজ করে। তাই প্রতিটি অঙ্গের জন্য আলাদা করে জিনগত ‘সুইচ’ শনাক্ত করা জরুরি।
ওয়াং ওয়ে বলেন, “এই গবেষণা প্রমাণ করেছে, জিনগতভাবে এমন সুইচ রয়েছে যা অঙ্গ পুনর্জন্ম চালু করতে পারে। এখন আমাদের কাজ হলো অন্য অঙ্গের সেই সুইচগুলো খুঁজে বের করা।”
যদিও এটি এখনো ইঁদুর পর্যায়ে সীমাবদ্ধ, বিজ্ঞানীরা আশাবাদী—একদিন এই গবেষণা পঙ্গু মানুষদের জীবনেও নতুন আশার আলো জ্বালাবে।