চলচ্চিত্রকে যদি আশ্চর্যের এক আকাশ ধরা হয়, তবে জহির রায়হান নিঃসন্দেহে সেই আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ফাগুনকে দ্বিগুণ করার ফুলকি এঁকে আলো ছড়িয়েছেন আর্কটারাস তারার মতো। প্রথমে চেয়েছিলেন চিত্রগ্রাহক হতে, কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায় হয়ে উঠলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা। তবে তার নির্মাতা পরিচয়ই তাকে সবচেয়ে বেশি আলোয় ভরিয়ে তুলেছে।
চিত্রগ্রাহক হওয়ার স্বপ্নে কলকাতার প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফিতে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। হাতে-কলমে চলচ্চিত্র শেখা শুরু করেন কিংবদন্তি নির্মাতা এ জে কারদারের কাছে। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৯)-তে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন তিনি। এরপর যে নদী মরু পথে (১৯৬১)-তেও সহপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন।
তার প্রথম সিনেমা কখনো আসেনি (১৯৬১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে অনন্য সৃষ্টি। এরপর কাঁচের দেয়াল, পাকিস্তানের প্রথম রঙিন সিনেমা সংগম (১৯৬৪), প্রথম সিনেমাস্কোপ সিনেমা বাহানা (১৯৬৫), আনোয়ারা ও বেহুলা (১৯৬৬) নির্মাণ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া জীবন থেকে নেয়া হলো তার সবচেয়ে জনপ্রিয় সৃষ্টি। জীবদ্দশায় ১১টি সিনেমা নির্মাণ করেন তিনি। অসমাপ্ত থেকে যায় তার স্বপ্নের ছবি লেট দেয়ার বি লাইট।
স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণাপত্র তৈরি করেছিলেন জহির রায়হান। তাতে জাতীয় চলচ্চিত্র কারখানা, তরুণ নির্মাতাদের জন্য ‘সিনে ওয়ার্কশপ’সহ নানা পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেসব চাপা পড়ে যায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্টপ জেনোসাইড ও আ স্টেট ইজ বর্ন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে বিশ্ববাসীর সামনে পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা তুলে ধরেন তিনি।
স্বাধীনতার পর বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে গিয়ে জহির রায়হানও নিখোঁজ হয়ে যান। অকালমৃত্যু তার সৃষ্টিশীল যাত্রা থামিয়ে দিলেও তিনি হয়ে আছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা। আলমগীর কবীর, বাদল খন্দকার কিংবা তারেক মাসুদের মতো নির্মাতারা তারই আলোয় পথ খুঁজে পেয়েছেন।
সাহিত্যেও তার দখল ছিল সমান। আরেক ফাল্গুন ছিল ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস, যেখানে উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের সংগ্রাম, বন্দিত্ব ও দৃঢ় অঙ্গীকার। সেই উপন্যাসে যেমন উচ্চারণ হয়েছিল— “আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো”—তেমনি বাস্তবেও তার কলম ও ক্যামেরা গণমানুষের আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়েছে। জহির রায়হান শুধু এক প্রজন্মকেই নয়, বরং পুরো জাতির সংগ্রাম ও স্বপ্নকে আলোকিত করে গেছেন।