সমাজে বহুকাল ধরেই একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে—অঙ্কে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি দক্ষ। তবে ফ্রান্সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৫ লাখ শিশুর ওপর পরিচালিত এক দীর্ঘমেয়াদি সমীক্ষা এই ধারণার বিপরীতে চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে ছেলেমেয়ের মধ্যে গণিত বোঝার ক্ষমতায় কোনো প্রকৃত ফারাক নেই। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের গড়ে তোলা পরিবেশই মেয়েদের পিছিয়ে দিচ্ছে।
এই সমীক্ষার ফলাফল সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপীয় একদল গবেষকের মতে, প্রাথমিক স্তরে ছেলেমেয়েরা গণিতে প্রায় সমান দক্ষ থাকে। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেরা এগিয়ে যেতে শুরু করে এবং সময়ের সঙ্গে সেই ব্যবধান আরও বাড়ে।
গবেষণায় যুক্ত ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এলিজাবেথ স্পেল্ক। তিনি ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছিলেন, অঙ্ক বা বিজ্ঞানে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যের কোনো প্রমাণ নেই। ফ্রান্সের এই বৃহৎ সমীক্ষা সেই মতকে আরও শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া এই গবেষণায় দেখা যায়, স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগপর্যন্ত ছেলেমেয়েরা গণিত বিষয়ে প্রায় সমান দক্ষতা অর্জন করে। কিন্তু শিক্ষাজীবনের শুরুতেই এক অদৃশ্য বিভাজন তৈরি হয়। গবেষকরা মনে করেন, এর জন্য দায়ী হতে পারে সামাজিক ধ্যানধারণা, শিক্ষকের আচরণ বা পরিবারের প্রত্যাশা।
এরকম মত অতীতেও পাওয়া গেছে। ২০০৩ সালে নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় ৪০টি দেশের প্রায় তিন লাখ কিশোর-কিশোরীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়—যেখানে মেয়েরা ছেলেদের সমান সুযোগ পায়, সেখানে গণিতে মেয়েরা পিছিয়ে পড়ে না। বরং অনেক সময় তারা ছেলেদের চেয়েও ভালো ফল করে।
তাহলে প্রশ্ন উঠছে—ফ্রান্সের মতো একটি দেশে, যেখানে আর্থসামাজিক বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে মেয়েরা কেন ধীরে ধীরে গণিতে পিছিয়ে পড়ে? গবেষকদের মতে, এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে সমাজের গঠন এবং চারপাশের মনোভাবের মধ্যে।
সবশেষে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে উঠে আসে—জন্মগত বা মস্তিষ্কজনিত কারণে ছেলেমেয়ের গণিতে পার্থক্য তৈরি হয় না। বরং যদি সমাজে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে অঙ্কে মেয়েরা ছেলেদের থেকে পিছিয়ে থাকবে—এই ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।